আমাদের সমাজে লিঙ্গ এবং যৌন পরিচয় নিয়ে গড়ে ওঠা অনেক ধারণা ও মিথ্যা বিশ্বাস প্রায়ই আমাদের বোঝাপড়া এবং গ্রহণযোগ্যতার পথে বাধা সৃষ্টি করে। এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে, আমি লিঙ্গ এবং যৌন পরিচয়ের পার্থক্য এবং তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি গভীর ও বিস্তারিত আলোচনা করব। আমার উদ্দেশ্য হলো এমন সব অদেখা ও অনেক সময় অকথিত থাকা বিষয়গুলো তুলে ধরা, যা প্রায়ই আমাদের সাধারণ আলোচনার বাইরে থাকে।
এই ব্লগে, আমি কোনো বিশেষ ধর্মীয় বা সামাজিক বিশ্বাসের পক্ষ বা বিপক্ষে যাব না; বরং আমি চেষ্টা করব একটি সর্বজনীন এবং সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে। আমার লক্ষ্য হলো সমকামিতা, বৈপরীত্যকামিতা, বাইসেক্সুয়ালিটি এবং অন্যান্য যৌন পরিচয়ের বিষয়গুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা, যাতে পাঠকরা নিজেদের মতামত গঠনে স্বাধীন থাকতে পারেন। আমার প্রয়াস হবে এই জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়গুলো সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো এবং বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে সম্মান জানানো।
জৈবিক লিঙ্গ (Biological Sex)
জৈবিক লিঙ্গ হলো একজন ব্যক্তির জন্মের সময় শারীরিক এবং আনুবংশিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত লিঙ্গ। এটি সাধারণত দুই প্রধান শ্রেণীবিভাগে বিভক্ত: পুরুষ এবং মহিলা। জৈবিক লিঙ্গ নির্ধারিত হয় ক্রোমোজোমের সংমিশ্রণের মাধ্যমে; যেমন XY ক্রোমোজোমের সংমিশ্রণ সাধারণত পুরুষ লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য এবং XX ক্রোমোজোমের সংমিশ্রণ সাধারণত মহিলা লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়।
জৈবিক লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রজনন অঙ্গগুলি, হরমোনের মাত্রা, এবং শারীরিক গঠন। যাইহোক, কিছু ব্যক্তি ইন্টারসেক্স হিসাবে জন্মান, যার মানে তাদের শারীরিক গঠন বা আনুবংশিক মেকআপ স্পষ্টভাবে ‘পুরুষ’ বা ‘মহিলা’ কোনো একটি শ্রেণীর মধ্যে না পড়ে। এই বৈচিত্র্য দেখায় যে, জৈবিক লিঙ্গের ধারণা সবসময় সহজ বিভাজনে ফিট হয় না।
যখন একজন ব্যক্তি পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকারের জেনিটালিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এই অবস্থাটি সাধারণত ইন্টারসেক্স হিসেবে পরিচিত। ইন্টারসেক্স ব্যক্তিদের ক্রোমোজোমের ধরণ ভিন্ন হতে পারে। ইন্টারসেক্স অবস্থার সাথে যুক্ত একটি সাধারণ ক্রোমোজোমাল প্যাটার্ন হল 46,XX/46,XY কাইমেরিজম বা মোজাইসিজম। তবে, প্রতিটি ইন্টারসেক্স ব্যক্তির জেনিটালিয়া অবশ্যই পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকারের হয় না এবং ইন্টারসেক্স অবস্থাগুলি বিভিন্ন জেনেটিক, ক্রোমোজোমাল, এবং হরমোনাল কারণের ফলে ঘটে।
46,XX/46,XY কাইমেরিজম বা মোজাইসিজম:
• এই অবস্থায় শরীরের কিছু কোষ XX ক্রোমোজোম যুক্ত এবং অন্যান্য কোষ XY ক্রোমোজোম যুক্ত হয়। এটি পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকারের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, সহ জেনিটালিয়ার বিকাশে পরিণত হতে পারে।
• কাইমেরিজম তখন ঘটে যখন দুটি নিষিক্ত ডিম বা ভ্রূণ গর্ভাবস্থার শুরুতে একত্রিত হয়।
• মোজাইসিজম ভ্রূণ বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে মিউটেশনের ফলে ঘটে, যা দুই সেট কোষের সাথে ভিন্ন জেনেটিক মেকআপ তৈরি করে।
আরো কিছু ইন্টারসেক্স অবস্থার উদাহরণঃ
১. টার্নার সিন্ড্রোম (Turner Syndrome): এই অবস্থায়, একজন মহিলা শিশু কেবল একটি X ক্রোমোজোম নিয়ে জন্ম নেয় (45,X)। এই অবস্থায় সাধারণত বামনত্ব, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, এবং যৌনাঙ্গের অসম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
২. ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম (Klinefelter Syndrome): এই অবস্থায়, একজন পুরুষ এক্সট্রা X ক্রোমোজোম (47,XXY) নিয়ে জন্ম নেয়। এটি প্রজনন অঙ্গের অসম্পূর্ণ বিকাশ, বৃদ্ধির সমস্যা, এবং কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক এবং শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে।
৩. এন্ড্রোজেন অনুভূতির অসামঞ্জস্য (Androgen Insensitivity Syndrome): এই অবস্থায়, একজন ব্যক্তি XY ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মালেও, তার শরীর পুরুষ হরমোনের প্রতি অনুভূতিহীন। ফলস্বরূপ, তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য মহিলা হিসাবে প্রকাশ পায়, কিন্তু তিনি জন্মগতভাবে পুরুষ।
৪. কঙ্জেনাইটাল অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্লাজিয়া (Congenital Adrenal Hyperplasia): এই অবস্থায়, অতিরিক্ত অ্যাড্রেনাল হরমোনের উত্পাদন ঘটে। এটি মহিলা শিশুদের মধ্যে জন্মের সময় পুরুষের মতো জেনিটালিয়া বিকাশের কারণ হতে পারে।
৫. পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (Polycystic Ovary Syndrome): এই অবস্থায়, মহিলাদের ডিম্বাশয়ে অতিরিক্ত হরমোন উত্পাদন ঘটে, যা অনিয়মিত মাসিক চক্র, অতিরিক্ত চুল বৃদ্ধি, মুখের ব্রণ এবং অন্যান্য লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। এটি প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
৬. ভ্যাজাইনাল অ্যাট্রেশিয়া (Vaginal Atresia): এই অবস্থায় যোনিপথ অবরুদ্ধ থাকে বা অসম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়, যা মহিলাদের জেনিটাল ট্র্যাক্টের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৭. হার্মাফ্রোডিটিজম (Hermaphroditism): হার্মাফ্রোডিটিজম হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকারের জেনিটাল বৈশিষ্ট্য থাকে। এটি বিরল এবং জেনেটিক বা হরমোনাল কারণে ঘটে।
৮. এমআরকেএইচ সিন্ড্রোম (MRKH Syndrome): মায়ের-রোকিটানস্কি-কুস্টার-হাউজার সিন্ড্রোম, যা এমআরকেএইচ সিন্ড্রোম নামে পরিচিত, হলো এক ধরনের জন্মগত অবস্থা যেখানে মহিলার যোনি ও গর্ভাশয় সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না বা অনুপস্থিত থাকে। এই অবস্থায় মহিলারা সাধারণত স্বাভাবিক বাইরের জেনিটালিয়া এবং স্বাভাবিক যৌন হরমোন উৎপাদন করে, কিন্তু তারা মাসিক হয় না এবং প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণে অক্ষম হতে পারেন।
৯. XXX সিন্ড্রোম: তিনটি X ক্রোমোজোম বিশিষ্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে, যাকে ট্রিপল X সিন্ড্রোম বা ট্রিসোমি X বলা হয়। এই অবস্থায়, কিছু শারীরিক ও বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর কোনো স্পষ্ট লক্ষণ থাকে না।
১০. XXY সিন্ড্রোম: XXY ক্রোমোজোম সংমিশ্রণ, যাকে ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম বলা হয়, এই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিরা শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও তাদের বৃদ্ধি ও প্রজনন সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে।
এছাড়া আরো অনেক প্রকারের ইন্টারসেক্স অবস্থা আছে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Intersex
জৈবিক লিঙ্গ (Biological Sex) এবং লিঙ্গ (Gender) পরিচয় অবশ্যই একই নয়। একজন ব্যক্তির জৈবিক লিঙ্গ তার লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে মেলে নাও পারে, যা তার নিজের আত্মজ্ঞান এবং সামাজিক পরিচয়ের ভিত্তি করে গঠিত হয়।
ট্রান্সজেন্ডার কি?
ট্রান্সজেন্ডার একটি সম্মিলিত পরিভাষা (আমব্রেলা টার্ম), যা ঐতিহ্যগত পুরুষ এবং নারী লিঙ্গের বাইরে থাকা সব ধরনের লিঙ্গ পরিচয়কে আবদ্ধ করে। এটি শুধুমাত্র যে পুরুষ বা নারী নয় সেই সব লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষজনকে নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্প্রদায়ও অন্তর্ভুক্ত। এই পরিভাষাটি লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্য এবং জটিলতাকে স্বীকার করে, এবং ব্যক্তির নিজের অনুভূতি এবং পরিচয়ের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রাখে। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি এমন সব মানুষের অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বকে সম্মান জানায়, যারা নিজেদের জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে পরিচয় অনুভব করেন না এবং নিজেদের লিঙ্গ পরিচয়ের সংজ্ঞা নিজেরাই গড়ে তোলেন।
https://en.wikipedia.org/wiki/Transgender
https://www.cdc.gov/lgbthealth/transgender.htm
https://en.wikipedia.org/wiki/Trans_woman
https://en.wikipedia.org/wiki/Trans_man
হিজলা / হিজরা / বৃহন্নলা / তৃতীয় লিঙ্গ কি?
বাংলাদেশে “তৃতীয় লিঙ্গ” লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এমন একটি লিঙ্গ পরিচয়, যা ব্যক্তির শারীরিক গঠন এবং যৌন পরিচয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যের উপর ভিত্তি করে। এই শ্রেণীবিভাগের আওতায় আসে তারা, যাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য তাদের জন্মগত লিঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই সম্প্রদায় সামাজিকভাবে এবং আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়, যা তাদের জন্য সমাজে আরও স্বীকৃতি এবং অধিকারের পথ তৈরি করেছে।
লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি (Sex Change Operation)
অন্যান্য দেশগুলিতে, লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি অনেক সময় ট্রান্সজেন্ডার বা অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের জন্য একটি সাধারণ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। এই সার্জারি তাদের শারীরিক পরিচয় ও মানসিক পরিচয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনে সাহায্য করে। তবে, বাংলাদেশে এই ধরনের সার্জারি এখনও অনেক কম এবং প্রায়ই সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বা বিতর্কিত বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এর কারণগুলি অনেক, যেমন সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মতামত, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, এবং চিকিৎসা সেবার অপ্রাপ্তি।
যদিও বিশ্বের অনেক দেশে লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি প্রচলিত ও সাধারণ হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া এখনও বেশ সীমিত এবং অনেক বেশি সময় নিতে পারে। এর একটি মুখ্য কারণ হলো, ইন্টারসেক্স বা হিজলা শিশুদের প্রতি আমাদের সমাজ ও পরিবারের অনুমোদন ও গ্রহণযোগ্যতা এখনও সীমিত। এই শিশুদের প্রতি সামাজিক সহানুভূতি ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং তাদের যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এখন পর্যন্ত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে, লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি ও তার সম্পূর্ণ চিকিৎসা সেবা প্রদান এই অঞ্চলে আরও ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে সময় নিতে পারে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Gender-affirming_surgery
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৃতীয় লিঙ্গের বিভিন্ন ধরন ও তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গ পরিচয় ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. পুরুষাকৃতি কিন্তু মহিলার জেনিটালিয়া যুক্ত (Male Appearance with Female Genitalia): এই শ্রেণীর হিজড়ারা বাহ্যিকভাবে পুরুষের মতো দেখতে হলেও তাদের মহিলার জেনিটালিয়া থাকে। এই ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে ইন্টারসেক্স বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে।
২. মহিলার আকৃতি কিন্তু পুরুষের জেনিটালিয়া যুক্ত (Female Appearance with Male Genitalia): এই ধরনের হিজড়ারা বাহ্যিকভাবে নারীর মতো দেখতে হলেও তাদের পুরুষের জেনিটালিয়া থাকে। তারা নিজেদের মহিলার মতো পোশাক এবং সাজসজ্জা করে থাকেন।
৩. ইন্টারসেক্স হিজড়া (Intersex Hijra): ইন্টারসেক্স হিজড়ারা জন্মের সময় থেকেই পুরুষ এবং নারী উভয়ের জেনিটালিয়া বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের শারীরিক গঠন পুরুষ ও নারী উভয়ের মিশ্রণ হতে পারে।
৪. ট্রান্সজেন্ডার হিজড়া (Transgender Hijra): এই শ্রেণীর হিজড়ারা বাহ্যিকভাবে এক লিঙ্গের হলেও তারা নিজেদের অন্য লিঙ্গের হিসেবে পরিচয় দেন এবং তাদের আচার-আচরণ, পোশাক এবং সাজসজ্জা সেই লিঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এরা জন্মগতভাবে পুরুষ বা নারী হতে পারেন, কিন্তু নিজেদের অন্য লিঙ্গের হিসেবে উপস্থাপন করেন।
৫. হিজড়া যারা সার্জারি করেছেন (Post-Operative Hijra): এই ধরনের হিজড়ারা জেনিটাল রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি (জেনিটাল পুনর্নির্মাণ অপারেশন) করে নিজেদের শারীরিক গঠনকে নিজেদের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নিয়েছেন। এই প্রক্রিয়া তাদের লিঙ্গ পরিচয় এবং শারীরিক গঠনের মধ্যে অধিক সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে।
যৌন অভিমুখীতা বা সেক্সুয়াল অরিয়েন্টশন বা যৌন পরিচয়
যৌন অভিমুখীতা বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন হলো একজন ব্যক্তির যৌন, রোমান্টিক বা আবেগগত আকর্ষণের প্রকৃতি। এটি ব্যক্তির যে লিঙ্গ বা লিঙ্গগুলির প্রতি তার আকর্ষণ বোঝায়, তা স্থায়ী এবং প্রাকৃতিক। যৌন অভিমুখীতার বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যেমন হেটেরোসেক্সুয়ালিটি, যেখানে একজন ব্যক্তি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হন; হোমোসেক্সুয়ালিটি, যেখানে সমান লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে; বাইসেক্সুয়ালিটি, যেখানে উভয় লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বিদ্যমান; এবং এসেক্সুয়ালিটি, যেখানে কোনো লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুপস্থিত। যৌন অভিমুখীতা একজন ব্যক্তির পরিচয়ের একটি অংশ, এবং এটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার এবং পছন্দের প্রতিফলন। সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন মুলত চার প্রকারঃ
১. বিপরীতকামিতা বা হেটারোসেক্সুয়ালঃ বিপরীতকামিতা বলতে বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ” কে বোঝায়। যৌন অভিমুখীতা হিসেবে বিপরীতকামিতা বলতে বোঝায় মূলত বিপরীতলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “আবেগীয়, রোমান্টিক বা যৌন আকর্ষণের একটি স্থায়ী কাঠামোবিন্যাস”। এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কোনো সম্প্রদায়কেও এই শব্দটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়। এই সেক্সুআল অরিয়েটেশনটি সর্বজন গৃহীত এবং সবচেয়ে প্রচলিত। অর্থাৎ, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর সমন্বয়ে এটি গঠিত।
২. সমকামিতা বা হোমোসেক্সুয়ালঃ সমকামিতা বলতে সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ” কে বোঝায়। যৌন অভিমুখীতা হিসেবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “আবেগীয়, রোমান্টিক বা যৌন আকর্ষণের একটি স্থায়ী কাঠামোবিন্যাস”। এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কোনো সম্প্রদায়কেও এই শব্দটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়। বাংলাদেশে সমকামিতা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। বাংলাদেশে বলাৎকার (পায়ুসঙ্গম) ও ধর্ষন একই অর্থে ব্যাবহত হয় তবে বাংলাতে ধর্ষন সাধারনত নারীর সাথে জোরপূর্বক সেক্স করা বুঝায়, আর বলাৎকার সাধারনত পুরুষের সাথে জোরপূর্বক সেক্স করা বুঝায়।
৩. উভকামী বা বাইসেক্সুয়ালঃ উভকামিতা বলতে সম এবং বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি “রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ” অথবা যে কোন যৌনতা বা লিঙ্গ পরিচয়বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতি রোমান্টিক বা যৌন আকর্ষণ কে বুঝানো হয়। উভকামিতা পরিভাষাটি নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতি যৌন বা রোমান্টিক অনুভূতি নির্দেশক মানব আকর্ষণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৪. নিষ্কামিতা বা অ্যাসেক্সুয়ালঃ নিষ্কামিতা হল কারও প্রতি যৌন আকর্ষণের অভাব বা যৌন কর্মকান্ডে অনুভূতি এবং আগ্রহের অভাব বা অনুপস্থিতি। একে কোন যৌন পরিচয় ধারণ না করা বা বিপরীতকামিতা ও সাধারণ যৌনতার প্রকরণসমূহের একটি হিসেবে ধরা হয়। নিষ্কামিতা ব্যক্তির আচরণ ও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তবে যদি এটি যৌন আচরণ না হয়ে যৌন পরিচয় হয় তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। নিষ্কামিতা যৌন আচরণ বা প্রবৃত্তির বিষয় নয়, বরং এটি একজন ব্যক্তির যৌন পরিচয়ের একটি অংশ। এর অর্থ এই নয় যে নিষ্কামী ব্যক্তিরা যৌনতা বা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনাগ্রহী, বরং তারা যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন না অথবা অতি সীমিতভাবে অনুভব করেন। তবে, নিষ্কামী ব্যক্তিরা ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং মানসিক সম্পর্কের প্রতি সম্পূর্ণ সক্ষম হতে পারেন। নিষ্কামী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে নিজ সঙ্গীকে খুশি করার জন্য এবং সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌন কর্মকান্ডে অংশ নেন।
হোমোসেক্সুয়াল/সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার: পার্থক্য বিশ্লেষণ
হোমোসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডার শব্দ দুটি প্রায়ই বিভ্রান্তির জন্ম দেয়, কিন্তু এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যা মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
হোমোসেক্সুয়ালঃ হোমোসেক্সুয়ালিটি হল যৌন প্রবণতা বা আকর্ষণের একটি ধরণ, যেখানে একজন ব্যক্তি তার একই লিঙ্গের অন্য ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। সহজ ভাষায়, একজন পুরুষ যদি অন্য পুরুষের প্রতি এবং একজন নারী যদি অন্য নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন, তাহলে তাদেরকে হোমোসেক্সুয়াল বলা হয়।
ট্রান্সজেন্ডারঃ ট্রান্সজেন্ডার হল লিঙ্গ পরিচয়ের একটি শ্রেণী, যা একজন ব্যক্তির জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে তার নিজের লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে অমিলের উপর নির্ভর করে। একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি তার জন্মের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য অনুভব না করে অন্য লিঙ্গের পরিচয় গ্রহণ করতে পারেন।
মূল পার্থক্যঃ এই দুই ধারণার মূল পার্থক্য হল, হোমোসেক্সুয়ালিটি যৌন আকর্ষণের দিকে নির্দেশ করে, অর্থাৎ কার প্রতি একজন ব্যক্তি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন, সেই সম্পর্কে বলে। অন্যদিকে, ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি লিঙ্গ পরিচয় বা একজন ব্যক্তি নিজেকে কিভাবে দেখেন এবং পরিচিত করেন, সে সম্পর্কে বলে।
হোমোসেক্সুয়াল একজন ব্যক্তি তার নিজের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য অনুভব করতে পারেন, কিন্তু তারা সেই একই লিঙ্গের অন্য কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন। অন্যদিকে, একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি নিজের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে তার জন্মের লিঙ্গের পরিচয়ের মধ্যে অমিল অনুভব করেন। এই দুই ধারণার মিল থাকতে পারে, অর্থাৎ একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি হোমোসেক্সুয়ালও হতে পারেন, কিন্তু এগুলি স্বতন্ত্র এবং আলাদা ধারণা।
সংক্ষেপে, হোমোসেক্সুয়ালিটি যৌন আকর্ষণের দিকে নির্দেশ করে, যখন ট্রান্সজেন্ডার লিঙ্গ পরিচয় এবং সেই পরিচয়ের সাথে একজন ব্যক্তির আত্ম-সনাক্তকরণের দিকে নির্দেশ করে।
ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
জৈবিক (Biological) দৃষ্টিকোণ:
১. জেনেটিক্স ও হরমোন: বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে যে, জেনেটিক, হরমোনাল এবং পরিবেশগত কারণগুলি মিলে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়ের বিকাশে অবদান রাখে। ভ্রূণের সময় হরমোনের পরিবর্তন লিঙ্গ পরিচয়ে প্রভাব ফেলতে পারে।
২. মস্তিষ্কের গঠন: কিছু গবেষণা দেখিয়েছে যে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কিছু অংশে পার্থক্য আছে, যা তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের অনুভূতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. ইন্টারসেক্স অবস্থা: কিছু ক্ষেত্রে, ব্যক্তিদের ইন্টারসেক্স হিসেবে জন্মায়, যেখানে তাদের জেনেটিক বা শারীরিক লিঙ্গ স্পষ্টভাবে পুরুষ বা নারী নয়। এই ধরনের বৈচিত্র্য লিঙ্গের বায়োলজিক্যাল স্পেকট্রামকে তুলে ধরে।
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC8799808/
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ:
১. জেন্ডার ডিসফোরিয়া: জেন্ডার ডিসফোরিয়া এমন একটি শব্দ যা যে কষ্ট বা অস্বস্তির বর্ণনা করে যা তখন হয় যখন কারও লিঙ্গ পরিচয় তার জন্মের লিঙ্গের সাথে মেলে না। অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি জেন্ডার ডিসফোররিয়া অনুভব করেন, যা লিঙ্গ সম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন হরমোন থেরাপি বা শল্য চিকিৎসা দ্বারা হ্রাস পেতে পারে।
২. পরিচয় বিকাশ: মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব অনুযায়ী, পরিচয়ের বিকাশে আত্ম-সনাক্তকরণ এবং ব্যক্তিগত লিঙ্গ পরিচয়ের বোঝাপড়া গুরুত্বপূর্ণ। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা তাদের লিঙ্গ পরিচয় বুঝতে, অনুসন্ধান করতে এবং তা স্বীকার করতে জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন।
https://en.wikipedia.org/wiki/Gender_dysphoria